পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন
ফোরকান আহম্মেদ
বিগত ২৫ আগস্ট/১৭ ইং থেকে মায়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ধর্ষণ নির্যাতন ও গণহত্যার মতো নৃশংস অভিযানে টিকতে না পেরে ৮ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে। এর মধ্যে ভারতের সরকারি হিসাবে ভারতেও ৪০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। ভারতের বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদিও ঐ সময় মায়ানমার সফরে ছিলেন। মায়ানমার সরকার জঙ্গি আখ্যায়িত করে নিরীহ রোহিঙ্গাদের বিতারিত করার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি মায়ানমার নেত্রী অং সান সূচিকে তার সরকারের নেয়া পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়ে এসেছেন। এ নিয়ে বাংলাদেশ ছাড়াও খোদ ভারতেও নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও সভা সমাবেশ হয়েছে। তবে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী রোহিঙ্গা বিষয়টিকে মানবিক বিবেচনায় দেখার কথা ঘোষণা করেছেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে রোহিঙ্গা বিষয়ে তিনি একমত হতে পারেননি। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বহু যুক্তিতর্কের পর বিষয়টি ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে গিয়ে গড়ায়।
গত ৩ অক্টোবর মঙ্গলবার ভারতের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট রোহিঙ্গাদের বিষয়টি মানবিকতা দিয়ে বিচার করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকার ৫ অক্টোবর সংখ্যার শেষ পৃষ্ঠার প্রথম কলামে কলকাতা প্রতিনিধির বরাত দিয়ে পত্রিকাটি লিখেছে মানবিকতা এবং আন্তর্জাতিক দায়িত্ব মাথায় রেখে রোহিঙ্গা নারী শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থদের রক্ষা করা সম্ভব কিনা- সেটা বিবেচনা করার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে বলেছে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র, বিচারপতি এএম খানওয়াইলকর এবং বিচারপতি ডি ওয়াই চন্ত্রচুড়ের বেঞ্চ এ রায় দেন। শুনানিতে রোহিঙ্গাদের পক্ষে বিতর্কে অংশ নেন বিশিষ্ট আইনজীবী ফলি নরম্যান। আদালতে মানবিকতার বিষয়টি তুলে ধরে পশ্চিমবঙ্গের শিশু অধিকার রক্ষা কমিটিও। বাংলাদেশের রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী তথা সচেতন মহলের মতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় মায়ানমার ইস্যুতে মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন তা পশ্চিম বাংলার ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। একই সাথে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী যেটা করতে পারেননি তিনি তা পেরেছেন। শ্রদ্ধাভাজন মমতা বন্দোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষ নেতাদের এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, 'সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।'
'বাংলাদেশের তৃণমূলের সাধারণ মানুষ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর রোহিঙ্গা বিষয়ক সিদ্ধান্তে আনন্দিত উল্লসিত ও অভিভূত। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মনে করেন জনসেবক তথা প্রজাদরদী ও মানবপ্রেমী এ নেত্রী ভারতের রাজনীতিতে প্রয়াত শ্রীঁমতি ইন্দিরা গান্ধীর মতো একদিন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার প্রধানের দায়িত্ব পেয়ে ভারতকে একদিন উন্নয়নের শিখরে নিয়ে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে সক্ষম হবেন।
মায়ানমারের রাখাইন জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা কোনো নতুন ঘটনা নয়। বিভিন্ন তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯০ ইং সালে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের কঙ্বাজারে আসে। তাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে খোলা হয় আশ্রয় শিবির। ১৯৯৪ সালে তদানীন্তন মায়ানমার সরকার বাংলাদেশে আসা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়। কিন্তু কিছু রোহিঙ্গা ফিরে যেতে পারলেও বেশিরভাগই যেতে পারেনি। আমাদের দেশের বেশির ভাগ রাজনীতিকই মনে করেছেন মায়ানমার থেকে সুচির দফতরের যে মন্ত্রী বাংলাদেশের এসে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে হয়তো ভবিষ্যতে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেই রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে। কিন্তু নিকট অতীতের ইতিহাস তা সমর্থন করে না। অতীতে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারেনি মায়ানমার কর্তৃপক্ষ। কারণ মগনামধারী এ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ইতিহাস কখনোই সুখকর ছিল না।
বাংলাদেশের প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট এবনে গোলাম সামাদ তার একটি প্রবন্ধে আরাকান রাজসভার দুজন বাঙালি মুসলমান রাজকবি ও মগদের পরিচিতি তুলে ধরেছেন। আমরা মায়ানমার বা বার্মার গোড়ার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখতে পাই আরাকানের হিন্দুরাজা নরমিখলাকে বার্মার মগ রাজা যুদ্ধে পরাজিত করে আরাকান রাজ্য (রাখাইন) দখল করে নেয় ১০৪৪ খ্রিস্টাব্দে। রাজা নরমিখলা ঐ সময় বাংলার রাজধানী গৌড়ে পালিয়ে যান তিনি সে সময়ের গৌড়ের শাসনকর্তা সুলতান জালালউদ্দিন শাহ'র কাছে আরাকান পুনর্দখলের জন্য গৌড় সুলতানের সাহায্য প্রার্থনা করেন। দীর্ঘ ২৪ বছর বাংলায় নির্বাসনে থাকার পর গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দিন শাহ্ নরমিখলার সাহায্যার্থে ৩০ হাজার সৈন্য প্রেরণ করলে আরাকান রাজ্য বার্মি জঙ্গিগোষ্ঠী মগমুক্ত হয় এবং নরমিখলা তার হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধার করে সোলায়মান শাহ্ নাম ধারণ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এরই মধ্যে আরাকানে (রাখাইন) খোদ বার্মার মূল অধিবাসী মগদের রাখাইন এনে বসতি স্থাপন করেন মগরাজা। তারা আরাকানে স্থায়ী বসতি গড়ার পর বর্তমান বাংলাদেশের চিটাগাং এলাকার কিছু অংশে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে থাকে এবং ঐ এলাকার মানুষের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করতে থাকে। এ কারণে বাংলার শান্তিপ্রিয় মানুষ মগদের ঘৃণার চোখে দেখতে থাকে।
আমার মরহুম পিতা মৌলভী মো. দলিলউদ্দিন বেপারী ছিলেন একজন আদর্শবান কৃষক। প্রচুর ভূ-সম্পদের মালিক থাকার কারণে আমার মরহুম পিতামহ তাঁর ছেলেদের একাডেমিকাল শিক্ষায় খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না। ব্রিটিশ আমলের বাল্যশিক্ষা বই পড়ে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ এবং পবিত্র কোরান পাঠ করা পর্যন্তই ছিল আমার মরহুম পিতার বিদ্যা-শিক্ষার উচ্চতা। বর্তমান সময়ের ৩য় শ্রেণি পাস আমার পিতাকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাবা মগ কি? এরা কারা? বাবা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন এরা দুষ্কৃতকারী, এরা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের সাথে মারামারিতে লিপ্ত হয়। সময়টা ছিল ষাটের দশকের শেষ দিকে। অর্থাৎ '৬৮-'৬৯ ইং সালের দিকে। আমি তখন মাধ্যমিক স্তরের ৮ম/৯ম শ্রেণি পড়ুয়া ছাত্র। আমাদের বাংলা ব্যাংকরণ বইয়ের বাগধারা চ্যাপ্টারে মগের মুল্লুক দেখে পিতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মগরা কি?
এবনে গোলাম সামাদ তার লেখায় মগ অর্থ ও তাদের ইতিহাস সম্পর্কে লিখেছেন, মগ বলতে ঠিক কাদের বোঝানো হতো তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। অনেকের মতে মগ শব্দের উদ্ভব হয়েছে প্রাচীন মগধের নাম থেকে। চট্টগ্রামের একদল লোককে বলা হয় বড়ুয়া মগ। এরা দাবি করেন যে, এদের পূর্ব পুরুষ চট্টগ্রাম অঞ্চলে এসেছিলেন মগধ থেকে। আরাকানে এক সময় মগধ থেকে আসা রাজবংশ রাজত্ব করেছেন এরকম কথাও অনেকেই বলেন।
তাদের মতে মগ কথাটার উদ্ভদ হয়েছে মগধ থেকে। অন্যদিকে ভিন্ন মতাবলম্বীদের মতে মগ শব্দের উদ্ভব হয়েছে মঙ শব্দ থেকে। মগ বলতে বোঝাত বর্তমান মায়ানমারের অধিবাসীদের। এরা ছিল খুবই দুর্দান্ত এবং ভয়ঙ্কর প্রকৃতির। যে ভয়ঙ্কর মূর্তি এখনও দৃশ্যমান। মায়ানমারের সাম্প্রতিক গণহত্যা যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রকৃতপক্ষে মগ শব্দের আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী আর আমাদের বাংলা সাহিত্যের 'মগের মুল্লুক' এর অর্থ হচ্ছে অরাজক দেশ। অতীতে আরাকানে এসে একদল মগ বসবাস শুরু করে। এরা আদিম জামানার মানুষের মতো উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। তারাই এক সময় পর্তুগীজ জলদস্যুদের সাথে হাত মিলিয়ে অবিভক্ত বাংলার তথা বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এলাকায় সৃষ্টি করেছিল বিরাট অরাজক অবস্থা।
মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে বাংলার সুবেদার ছিলেন শায়েস্তা খাঁ। সুবেদার শায়েস্তা খাঁ সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে মগ ও জলদস্যুদের যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করে চট্টগ্রামকে মগ ও জলদস্যুমুক্ত করেছিলেন। সুবেদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধজয়ের পর চট্টগ্রাম শহর ও বন্দরের নতুন নাম রেখেছিলেন 'ইসলামাবাদ'।
বাংলাদেশের শান্তপ্রিয় সাধারণ মানুষ গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, ইতিহাস স্বীকৃত একটা অসভ্য জাতি জঙ্গি জাতি গোটা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের আহ্বান/অনুরোধ উপেক্ষা করে রাখাইনের (আরাকান) মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাদের ধর্ষণ ও গণহত্যার মাধ্যমে নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছে এবং এখনও যা অব্যাহত রয়েছে।
'আমাদের বাংলা সাহিত্যে একটি কথা আছে অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেনো তৃণসম দহে।' 'বাংলাদেশের তৃণমূলের আপামর জনতা মনে করেন সৌদি আরবের মহামান্য বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ, তুরস্কের মহামান্য প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের মতো পরাক্রমশালী মুসলিম নেতৃত্বের যৌথ উদ্যোগে শায়েস্তা খানের মতো বর্তমান বিশ্বের দুর্দমনীয় সম্মিলিত শক্তির সহযোগিতা খুবই জরুরি।
ফোরকান আহম্মেদ : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।