মোদির বন্ধুত্ব, আহা ! মানবতা !!
রাজু আহমেদ
ভারত বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র, এটা যারা স্বীকার করে তাদের সাথে ঝগড়ায় পরে আসছি ! সমপ্রতি ব্রিকস সম্মেলন শেষে চীন থেকে সরাসরি মায়ানমার সফরে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মায়ানমারের গণতন্ত্রের জননী খ্যাত অং সাং সুচিকে ভরসা দিয়ে বলেছেন, ভারত সর্বাত্মকভাবে মায়ানমারের পাশে আছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে বন্ধু সুলভ সম্পর্ক উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ বটে কিন্তু এটা এমন সময়ে যখন মায়ানমার-ভারত সীমান্ত দিয়ে লাখখানেক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বিএসএফ মরণমুখে পুশ ব্যাক করেছে এবং যা হাজার কয়েক রোহিঙ্গা ভারতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল তাদেরকেও ভারতের বিদেশ মন্ত্রক অবৈধ অভিবাসী আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে ভারত থেকে বের করার ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের নাকের ডগায় মানুষ হত্যার এমন বর্বোরোচিত কর্মকা-ের বিরুদ্ধে মোদি একটি কথাও উচ্চারণ না করে বরং সুচি সরকারের কর্মকা-ের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে তিনি বাংলাদেশের সাথে ভারতের বন্ধুত্বকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেলেন ? প-িতেরা ভাবুক !
সমপ্রতি জাতিসংঘ স্বীকার করেছে, স্বভূমে উদ্বাস্তু তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মায়ানমারের আরাকান থেকে বিতারিত হয়ে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলায় আশ্রয় নিয়েছে। আরও লাখ চারেক আশ্রয়ের প্রত্যাশায় সীমান্তে অপেক্ষমান এবং নিত্যদিন আরাকান থেকে বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গার ঢল নামছে। বাংলাদেশ সরকার শুরুতে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স দেখালেও বিগত কয়েকদিনে বেশ যত্নসহকারেই তাদেরকে কেবল মানবিকতার খাতিরে গ্রহণ করছে। ইতোমধ্যে মুসলিম বিশ্বের বেশ কিছু দেশ রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছে এবং তুরস্কের ফার্স্ট লেডিসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ মন্ত্রী-কর্মকর্তা পরিস্থিতি সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে গেছেন।
মানবিকতার খাতিরে রোহিঙ্গাদের দিকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করার জন্য বাংলাদেশ অবশ্যই বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত হবে এবং কিছুটা ফায়দাও পাবে কিন্তু আখেরে কোনো সর্বনাশ ঘটার সম্ভাবনা কী একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় ? যে পার্বত্য অঞ্চলে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে এটা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের অখ- সার্বভৌমত্বকে বিলীন করার ষড়যন্ত্রকারীদের প্রথম টার্গেট বাংলাদেশের এ অঞ্চল বিচ্ছিন্ন করা। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর বৃহৎ শক্তি এখানে নিয়োজিত করা হয়েছে শুধুমাত্র সন্ত্রাসী কর্মকা- ঠেকাতে, তাও সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে এমনিতেই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শেষ নাই, তার ওপর লাখ কয়েক রোহিঙ্গাকে এখানে আশ্রয় দেয়ায় পরিস্থিতি যে অচিরেই বাংলাদেশের জন্য অস্বস্তিদায়ক হবে না এমন নিশ্চয়তা মোটেও নাই বরং শঙ্কা আছে বহুগুণ। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য নতুন নয় বরং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ জুড়ে স্বভূমে অত্যাচারের শিকার হয়ে এরা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। এদের সবাই যে এখানে এসে সভ্য আচরণ করছে তাও ঠিক নয়। কাজেই রোহিঙ্গা কেন্দ্রিক ইস্যুকে সরকার কতটা বুদ্ধিমত্তার সাথে সামলাতে পারবে তার সন্তোষজনক সমাধান সময় সাপেক্ষ।
ভারত যে বাংলাদেশের বন্ধু, এটা বাংলাদেশ সরকারের উচ্চমার্গের কর্তাব্যক্তিরা জনতাকে বোঝাতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। এমনকী ভারতবাসীর একাংশ প্রধানত যারা যখন সেখানের ক্ষমতায় থাকে তার প্রধানরাও মাঝে মাঝে বলেন, বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ককে তারা আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান, আরও পাশাপাশি, আরও কাছাকাছি, আরও লাগালাগি ! অথচ ভারত কর্তৃক বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ শেষ হয়েছে বলে ঘোষিত হয়েছে। প্রতিবেশী আচারে যতই নেমকহারাম হোক আমরা তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বহাল রেখে চলার সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। কখনও কখনও আমাদের জাতীয় স্বার্থ বিঘি্নত হয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে- এমন ঘটনা বিরল নয় বরং অতীত সম্পর্কের অলিগলি আঁতিপাঁতি করে না খুঁজলেও সে দৃষ্টান্ত ঢের পাওয়া যাবে। অথচ মোদিজী রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ভয়ানক সমস্যা, মানবতার প্রতি তীব্র আঘাতকে অন্ধচোখে দেখে কিরূপে মায়ানমার সরকারের পাশে লাগালাগির সম্পর্কের বাহুডোরে বাঁধলেন তা শুদ্ধকূটনীতি ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হবে। মোদিজীর আচরণ এ জাতিকে ভাবিয়ে তুলছে বোধহয়, ভারত কী বাংলাদেশের বন্ধু নাকি সর্বগ্রাসী শত্রু ?
দুঃখ কারও জন্যই চিরকাল স্থায়িত্ব পায় না। রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের ওপর মায়ানমার কর্তৃপক্ষ যে বর্বোরোচিত আচরণ করছে তা কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। বর্তমান সময় হাজার হাজার মানুষকে হত্যার দায়ে ইতিহাস অবশ্যই অং সাং সুচিকে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে দ- দেবে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিশ্ব নেতা ও সংগঠনগুলো প্রতিবাদমুখর হতে শুরু করেছে। অচিরেই হয়তো একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান নিশ্চিত হবে কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার নব্য মোড়ল তথা ভারতের প্রধানমন্ত্রী যে ভূমিকা নিলেন তাতে কালো অধ্যায়ের সূচনা তার কর্মকা-ের সাথে লেপিত থাকলো। রোহিঙ্গারা অন্ধকার ভেদ করে আলোর দেখা পেলেও মোদির ভূমিকাকে আর আলোবরণ করানো যাবে কি-না তা বলা মুশকিল। শুরুতে বলেছিলাম ঝগড়ার কথা ! আজকে নাইবা ঝগড়া করলাম। সবার সাথে বন্ধুত্বই থাক!
রাজু আহমেদ : কলামিস্ট
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।