দক্ষ জনশক্তির অভাবেও ভুগছে দেশ দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও দক্ষ কর্মী তৈরির প্রতিষ্ঠান নেই
দেশে প্রতিবছরই বাড়ছে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। অবস্থা এতটাই নাজুক হয়ে উঠেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে একজন দিনমজুরের আয়ের সমান বেতনে চাকরি পেতেও দিশাহারা হয়ে উঠতে হয়। অন্যদিকে দেশে দক্ষ কর্মীর অভাবে অনেক দেশি প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে লোক আমদানি করছে। এসব বিদেশি কর্মীরাও প্রতিবছর নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে শত শত কোটি টাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম ২৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। এর মধ্যে পুরুষ ১৪ লাখ, নারী ১২ লাখ ৩০ হাজার। যা মোট শ্রমশক্তির সাড়ে ৪ শতাংশ। ৩ বছর আগে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। গত ১ দশক আগে ছিল ২০ লাখ।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রেই দেশ দক্ষ কর্মী সঙ্কটে ভুগছে। দিন দিন বাড়ছে এ সঙ্কট। দক্ষ কর্মী সঙ্কট আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সঙ্কট মোকাবিলায় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই দেশের বাইরে থেকে কর্মী আনছে। শুধু দেশেই চাহিদা তা নয়, কর্মীদের দক্ষতার অভাব থাকায় বিদেশে বাংলাদেশের জনশক্তির বাজারও সঙ্কুচিত হচ্ছে। দক্ষ শ্রমশক্তির এ সঙ্কট শুধু প্রতিষ্ঠান চালানোর প্রতিবন্ধকতাই তৈরি করছে না, বাংলাদেশের দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনেও বাধা সৃষ্টি করছে। প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা সূত্রে জানা গেছে, তৈরি পোশাক, নির্মাণ, চামড়াজাত, কৃষি প্রক্রিয়াজাত_ এ রকম ৯টি খাতে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৫ লাখ দক্ষ শ্রমশক্তি দরকার হবে। কিন্তু এ চাহিদা পূরণের মতো দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে না। গড়ে তোলার সঠিক উদ্যোগও নেই। গবেষণা বলছে, ২০২৫ সাল নাগাদ সব মিলিয়ে ৭ কোটি ২০ লাখ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন হবে। কিন্তু সে ব্যাপারে প্রস্তুতি না থাকায় দক্ষ কর্মীর অভাবে ভুগবেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও দক্ষ কর্মী তৈরির প্রতিষ্ঠান তেমন একটা নেই। এ সঙ্কট দেশে শিক্ষিত বেকারের হার বাড়াচ্ছে। দেশকে নিয়ে যাচ্ছে ঝুঁকির মুখে, যার অবসানে এখনই জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিবিএস যে পরিসংখ্যান দিয়েছে, প্রকৃত বেকার আরও বেশি। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ৫ শতাংশের বেশি বেকার, সেখানে বাংলাদেশে সাড়ে ৪ শতাংশ বলা হচ্ছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, বর্তমান চাকরির বাজারে যোগ্যতা ও দক্ষতা খুবই কম। সনদ অনুযায়ী চাকরি মিলছে না। বাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থা সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় শিক্ষিত বেকার বেড়েই চলছে।
এদিকে বিশ্বব্যাংক মনে করে, সরকার কম দেখালেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর ওপর প্রতিবছর নতুন করে ১৩ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। সুতরাং নতুন কর্মসংস্থান তৈরির চাপ রয়েছে অর্থনীতির ওপর। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের হার ২ শতাংশ বাড়ানো গেলে প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে উন্নীত হবে। আবার আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আইএলও) 'বিশ্ব কর্মসংস্থান ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি-২০১৫' শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে বেকারত্ব বৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৬ সাল শেষে মোট বেকার দ্বিগুণ হবে। সংস্থাটির মতে, বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ১২তম।
আবার লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। ভারত ও পাকিস্তানে প্রতি ১০ জন শিক্ষিত তরুণের ৩ জন বেকার।
বিবিএসের হিসাবে, এক দশকে ১১ লাখ ৩০ হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। ফলে দেশে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৮৭ লাখে। এর মধ্যে পুরুষ কর্মজীবী ৪ কোটি ১৮ লাখ এবং নারী ১ কোটি ৭০ লাখ।
বিশ্বব্যাংকের কারিগরি সহযোগিতায় ২০১৫ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জরিপ করেছে বিবিএস। এটিই ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রথম শ্রমশক্তি জরিপ। এর আগে বিবিএস ৩ থেকে ৫ বছর পর পর শ্রমশক্তি জরিপ করতো। এতে মৌসুমভিত্তিক কর্মকা- সম্পর্কে কোনও ধারণা পাওয়া যায় না। এজন্য ত্রৈমাসিক জরিপ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিবিএস। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, শ্রমশক্তির বাইরে থাকা মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। বর্তমানে সাড়ে ৪ কোটি মানুষ শ্রমশক্তির বাইরে আছে। এর অধিকাংশই নারী। প্রায় ৩ কোটি ৫২ লাখ নারী শ্রমশক্তির বাইরে। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৬১ লাখ। পরিসংখান অনুযায়ী, বেকারত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে শহরের মানুষ। ২০০৫ সালে শহরে কর্মজীবী ছিল ১ কোটি ১৩ লাখ। ২০১৫ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬৪ লাখে। এ সময়ে গ্রামে কর্মজীবী বেড়েছে মাত্র ৪ লাখ।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্যমতে, ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সালে ১৫-২৪ বছর বয়সী বেকার যুবকের সংখ্যা ছিল ২৯ লাখ। কিন্তু ২০০৫ থেকে ১০ সালের মধ্যে তা প্রায় ৫ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৩২ লাখে। এখন এটি আরও কয়েকগুণ বেড়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু কাজ পায় মাত্র ৭ লাখ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ইউজিসির সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০১৩) বলা হয়, ২০১৩ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৭টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪ লাখ ১২ হাজার ৯শ ৪ জন শিক্ষার্থী স্নাতক শেষ করেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেছেন ৫৪ হাজার ১শ ৬০ জন। সেই হিসেবে এক বছরে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ স্নাতক বের হচ্ছেন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন প্রথম শ্রেণির চাকরিতে নিয়োগ দিয়েছে ১২ হাজারের কম। এক বছরে ব্যাংক, দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি ও বেসরকারি চাকরিতে দেড় লাখের বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। ফলে প্রায় অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীকেই চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক, অর্থনীতিবিদ ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে চাকরির সমন্বয় না থাকার কারণেই এমনটা হচ্ছে। অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা জরুরি। বিবিএসের হিসাবে, এক দশক আগে অর্ধেকের বেশি মানুষ কৃষিভিত্তিক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত ছিল। এখন ৫৬ শতাংশ মানুষ কৃষিবহির্ভূত খাতে নিয়োজিত। কর্মজীবীদের মাসিক আয়ের একটি হিসাবও করেছে বিবিএস। এতে দেখা গেছে, অর্ধেক কর্মজীবী মানুষ মাসিক ভিত্তিতে বেতন পেয়ে থাকে। এসব মানুষের গড় আয় ১১ হাজার ৬৮২ টাকা।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সিনিয়র সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলে আড়াই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হয়েছে। এর বাইরে বাণিজ্য বড় হয়েছে এবং অর্থনীতির বহুমুখিতার কারণে বেকারের সংখ্যা বাড়ার কথা নয়।
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।