কোরবানির শিক্ষা : আত্মত্যাগ এবং স্রষ্টার সন্তুষ্টি
আরিফ ইকবাল নূর
একদিকে হাজিরা হজ্বের কার্যক্রম সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, অন্যদিকে আমরা আল্লাহর দেয়া বিধান কোরবানির প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। কোরবানি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে এক বিশেষ অনুগ্রহ। কেননা বান্দাহ কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারে।
আমাদের জীবন, আমাদের সম্পদ সব কিছুই মহান আল্লাহর দান। পরম প্রভুর জন্য প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করতে পারাই কোরবানির মূল শিক্ষা। কোরবানির মাধ্যমে মহান প্রভুর জন্য ভালোবাসা ও ত্যাগের মাত্রা নির্ণীত হয়। আল্লাহর দান আল্লাহকে ফিরিয়ে দিতে আমরা কতটা প্রস্তুত, তারই একটি ক্ষুদ্র পরীক্ষা হলো কোরবানি। আমাদের জীবনসম্পদ আল্লাহর কাছে উৎসর্গ করার প্রতিশ্রুতিই গ্রহণ করি কোরবানির মাধ্যমে। মূলত আমাদের জীবন ও সম্পদের মালিক আল্লাহ। এ দুটো জিনিস আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যয় করাই ঈমানের অপরিহার্য দাবি এবং জান্নাত লাভের পূর্বশর্ত। মহান আল্লাহ বলেন, 'নিশ্চয়ই আমি মুমিনের জীবন ও সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছি। কাজেই জীবনসম্পদ আল্লাহর এবং তা আমাদের কাছে আমানত। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ও তার পছন্দনীয় পথে ব্যয় করাই ঈমানের দাবি। কোরবানি মানুষকে ঈমানের এ দাবি পূরণের উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।
কোরবানি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'হে নবী! নিশ্চয়ই আমি আপনাকে কাওসার দান করেছি, অতএব আপনি আপনার 'রব্থ এর সন্তুষ্টির জন্যে সালাত কায়েম করুন এবং তাঁর নামে কোরবানি করুন'। রাসূল (স) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করবে না সে যেন ঈদগাহের কাছেও না আসে। হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (স) বলেছেন, কোরবানি দিনে মানবসন্তানের কোন নেক আমলই আল্লাহ তায়ালার নিকট তত প্রিয় নয়, যত প্রিয় কোরবানি করা। কোরবানি পশুর শিং, পশম ও ক্ষুর কিয়ামতের দিন মানুষের নেক আমলনামায় এনে দেয়া হবে। কোরবানি পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দচিত্তে কোরবানি করো'' (তিরমিযী)।
প্রথম কোরবানি :
মানবসৃষ্টির শুরু থেকেই কোরবানির বিধান চলে আসছে। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতে এ কোরবানি ছিল একটি অপরিহার্য অংশ। মহান আল্লাহ বলেন, 'আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক রীতিপদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওই সব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যেসব আল্লাহ তাদের দান করেছেন' (সূরা হজ-৩৪)।
মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি হজরত আদম আ:-এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের কোরবানি। আন্তরিকতা ও উদ্দেশ্যের সততার কারণে হাবিলের কোরবানির কবুল হলো, কিন্তু নিষ্ঠার অভাব ও অমনোযোগিতার কারণে কাবিলের কোরবানি আল্লাহর কাছে প্রত্যাখ্যাত হলো।
আজকে মুসলিম সমাজে কোরবানি যে প্রচলন তা মূলত: মুসলিম মিল্লাতের বা জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ) এর দেখানো পথ বা সুন্নাত। হযরত ইব্রাহীম (আ) এর শতবর্ষ বয়সের পর আল্লাহ তায়ালা তাঁকে যে সন্তান দান করেছিলেন, তিনি আল্লাহ তায়ালা কতৃক আদিষ্ট হয়ে তাঁর সে কলিজার টুকরা হযরত ইসমাইল (আ) এর কোরবানি সূত্র ধরে আজও কোরবানি প্রচলিত আছে। কোরবানির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন হজরত ইবরাহিম (আ) ও হজরত ইসমাঈল (আ)। মহান আল্লাহর জন্য হজরত ইবরাহিম আ.-এর সর্বোৎকৃষ্ট ত্যাগ এবং হজরত ইসমাঈল (আ) এর আত্মোৎসর্গ আল্লাহর কাছে এতই পছন্দ হলো যে, তিনি ইব্রাহিম (আ) কে আপন বন্ধুরূপে গ্রহণ করলেন। শুধু তা-ই নয়, মহান আল্লাহ তাকে মুসলিম জাতির পিতার আসনে অভিষিক্ত করলেন এবং তার ছেলে ইসমাঈল (আ) এর পবিত্র বংশধারায় সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা) এর উত্থান ঘটালেন। তিনি হজরত ইব্রাহিম (আ) ও হজরত ইসমাঈল (আ) এর ত্যাগের ইতিহাসকে চিরঞ্জীব করে রাখার জন্য সর্বকালের সব সচ্ছল মানুষের জন্য কোরবানিকে বাধ্যতামূলক করলেন।
কোরবানির তাৎপর্য ও গুরুত্ব :
হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কতিপয় সাহাবা রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কোরবানি কি? রাসূল (সাঃ) বললেন, কোরবানি মুসলিম মিল্লাতের বা জাতির পিতা ইব্রাহীম (আঃ) এর সুন্নাত। তারা আবারো প্রশ্ন করলেন, এর মধ্যে আমাদের জন্যে কি আছে ? রাসূল (সাঃ) বললেন, কোরবানি পশুর প্রতিটা পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী আছে। তারা বললেন, ভেড়ার তো অসংখ্য পশম আছে। রাসূল (সাঃ) বললেন, ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী দেয়া হবে, যদি তা খালেস নিয়তে কোরবানি করা হয়' (ইবনে মাযাহ)। আবু দাউদ শরীফের এক হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মর্যাদার দিন হচ্ছে কোরবানি দিন।
কোরবানির শিক্ষা
কোরবানি মানুষ মাঝে সেচ্ছায় তার প্রতিপালকের সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় সবচাইতে প্রিয় বস্তুু ত্যাগ করার মানসিকতা সৃষ্টি করে। যেমন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) শুধু মাত্র স্বপ্নে দেখেছেন, তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাহে কোরবানি করো। আর তিনি তাঁর আদরের একমাত্র সন্তান হযরত ইসমাইল (আঃ)কে কোরবানি জন্যে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। পৃথিবীতে মানুষের কাছে সবচাইতে আকর্ষণীয় বস্তুর মধ্যে অর্থ-সম্পদ বা টাকা-কড়ি আর সন্তান অন্যতম। মহান আল্লাহর প্রেমে ও তাঁর নির্দেশের প্রাধান্য দানকল্পে এই অর্থ-সম্পদের মোহ ত্যাগের এ মানসিকতা সৃষ্টি করাই হচ্ছে কোরবানি শিক্ষা। কোরবানি আমাদের ঈমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি করে ও পরকালের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে। রাসূল (সাঃ) নির্দেশ করেছেন, হে লোকসকল তোমরা ত্রুটিমুক্ত ও উত্তম প্রাণী কোরবানি করো, কারণ কোরবানি এ পশুগুলো হবে তোমাদের জান্নাতে যাওয়ার বাহন।
কোরবানি সচ্ছল সকল মুসলমানের ওপর ওয়াযিব। কোরবানি গোস্তের ওপর আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর, গরীব-মিসকিনের ও মুসাফিরের হক আছে। তাদের হক আদায় করতে হবে।
আর কোরবানির উদ্দেশ্য আবশ্যই সৎ হতে হবে এবং তাতে ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ থাকতে হবে। কোরবানি প্রদর্শন ইচ্ছা ও অহঙ্কারমুক্ত হতে হবে। অনেকেই বাহবা পাওয়ার জন্য ও আলোচিত ব্যক্তিত্ব হওয়ার লক্ষ্যে লক্ষাধিক টাকার গরু বা উট কিনে লাল ফিতা বেঁধে পথে পথে ঘোরান। এটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি কোনো সচ্ছল ব্যক্তির জন্য জীর্ণশীর্ণ কম দামি পশু কোরবানিও অনুচিত। এ ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর বাণীর দিকেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ বলেন- 'ওই সব পশুর রক্ত- গোশত আল্লাহর কাছে কিছুই পৌঁছে না, বরং তোমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের তাকওয়া তাঁর কাছে পৌঁছে। এই আয়াত থেকে সুস্পষ্ট, উদ্দেশ্যের সততা ও খোদাভীতি কোরবানি কবুলের শর্ত। পশুটি কত বড় ও কত দামের সেটা আল্লাহর কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। ভোগ নয়, ত্যাগেই আনন্দ- এটিও কোরবানির একটি শিক্ষা। কোরবানির গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করে তাদের মুখে হাসি ফোটানোও কোরবানির অন্যতম লক্ষ্য। রাসূল সা: কোরবানির তিন ভাগের এক ভাগ গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করাকে মুস্তাহাব করেছেন। ইচ্ছে হলে এর বেশি; এমনকি সবটাও দান করা বৈধ। কোরবানির গোশত খাওয়া ও সংরক্ষণ বৈধ, তবে তা করতে গিয়ে কোরবানির আসল অন্যতম উদ্দেশ্য যেন লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকে আমাদের সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। শুধু পশু নয়, পশুত্ব কোরবানি করাও কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার সাথে আমাদের ভেতরের পশুত্বকেও কোরবানি করতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা আমাদের সব কিছু সহীহভাবে আমল করার তাওফীক দিন। পশু কোরবানির মাধ্যমে ঈমানের সাক্ষ্য প্রদান এবং পশুত্ব কোরবানির মাধ্যমে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়াই কোরবানির দাবি। কোরবানির মাধ্যমে ক্রোধ, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, শত্রুতা ইত্যাদি পশুত্বকে দমন করে মানুষের সুকুমারবৃত্তিগুলোকে জাগিয়ে তুলতে পারলে আমাদের কোরবানি সার্থক হবে এবং সমাজে শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে পড়বে।
আরিফ ইকবাল নূর : লেখক
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।