দশ মিনিটের মিশন
* শরীরে ১৪ কোপের দাগ * বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা * আতঙ্কে দেশ ছাড়ছেন বস্নগাররা * পাচ্ছেন না প্রশাসনিক সহযোগিতা
শিমুল চৌধুরী দ্রুব
রাজধানীর খিলগাঁও পূর্ব গোড়ানের ৮ নম্বর রোডের ১৬৭ নম্বর বাসা। গত শুক্রবার দুপুরে এই বাসারই পাঁচতলায় নৃশংসভাবে খুন হন মুক্তমনা বস্নগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় ওরফে নিলয় নীল। ঘটনার তিন দিন পার হলেও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। গ্রেফতারতো দুরের কথা এমনকি হত্যাকারিদের কাউকে সনাক্ত করতেও পারেনি তারা।
নিলয়ের স্ত্রী আশামনি ও আশামনি বোন তন্মীর ব্যবহারকৃত ফেসবুক পোষ্ট থেকে জানা যায়, ঘটনা ঘটেছিলো গত ৭ আগষ্ট শুক্রবার দুপুরের দিকে। দুপুরের পর হঠাৎ দরজার কড়া নাড়েন ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী এক যুবক। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তার পরনে ছিল গেঞ্জি ও জিন্সের প্যান্ট। কাঁধে ছিল একটি ব্যাগ। নিলয়ের স্ত্রী আশা মনি দরজা খুলে দিতেই যুবকটি জানায় বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলার পর সে নিলয়ের পাঁচ তলার ভাড়া বাসাটি দেখতে এসেছে। সে আরো জানায় চারতলাটি তারা কয়েকজন মিলে ভাড়া নিতে চায়, তাই এই বাসাটি দেখতে এসেছে। বাসায় ঢোকার পর লোকটাকে খুব উদ্বিগ্ন লাগছিলো। বারবার মোবাইলে কি যেন লিখার চেষ্টা করছিল লোকটা। বারবার বলছিল আপনাদের বাসাটাতো অনেক ছোট। এটার কত টাকা ভাড়া দেন আপনারা। আশা মনি ছেলেটাকে বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলতে বললেও ছেলেটি ঘড়ের ভিতরেই ঘোরাঘুরি করছিল এবং ফোনে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করছিলো। এরপর আশামনি নিলয়কে গিয়ে লোকটাকে চলে যেতে বলার জন্য পাঠান। সেসময় নিলয় ল্যাপটপে কাজ করছিল বলেও জানা যায়।
আরো জানা যায়, নিলয় উঠে যুবকটিকে কিছু বলতে যাবেন ঠিক এমন সময় তিনজন লোক হুড়মুড় করে বাসায় ঢুকে পড়ে। এদের মধ্যে একজন ছিলেন হালকা গড়নের ফর্সা মতো। আর একজন ছিলেন দাড়িওয়ালা। তারা ঢুকেই বাসায় অতিথি হিসেবে আসা আশামনির ছোট বোন তন্বীকে একটা কালো রঙ্গেও পিস্তল দেখিয়ে বলে 'কোন কথা বলবি না'। এই বলে বারান্দায় আটকে রাখে। সেখানে বসে তন্বী প্রাণপনে চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। নিলয়ের স্ত্রী আশামনি দাড়িওয়ালা ছেলেটার পায়ে ধরে নিলয়ের প্রাণ ভিক্ষা চাইলে তার চুলে ধরে টেনে হিচরে পাশের বারান্দায় নিয়ে আটকে রাখে। এরপর মাত্র আট থেকে দশ মিনিটের মধ্যে তারা নিলয়কে হত্যা করে চলে যায়।
নিলয়ের স্ত্রী আশা মনি বলেন, এত্ত চিৎকার করলাম। ওকে বাঁচাতে কেউ আগায়ে আসলো না। আমি দাঁড়িওয়ালা লোকটার পায়ে পরছিলাম। নিলয়ের প্রাণ ভিক্ষা চাইছিলাম। আমার চুল ধরে ঐ লোক বারান্দায় বন্দি করে রেখেছিল। খুনিরা 'নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার সস্নোগান' উচ্চারণ করতে করতে খুন করেছে বলেও জানান তিনি।
আশা মনি তার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ সাংবাদিকদের কাছে বিচার না হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, নিলয়কে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে ৬ মাস আগে অভিজিৎ দা'কেও একইভাবে খুন করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। আমি জানি অভিজিৎ দা'র মতো নিলয়ের হত্যাকারীদেরও বিচার হবে না।
ভবনের মালিক মো. শামসুল কবিরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিলয় তার স্ত্রী আশা মনিকে নিয়ে দুই বছর আগে বাসাটিতে ওঠেন। দুই কক্ষের বাসাটির ভাড়া ছিল ছয় হাজার টাকা। তবে ঘটনার সময় বাসাতে ছিলেন নেত্রকোনা থেকে বৃহস্পতিবার বেড়াতে আসা আশা মনির ছোট বোন ইশরাত তন্বীও। আশা ও তন্বীকে বারান্দায় আটকে রেখে নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি আরো জানান, তাদের এলাকার বেশির ভাগ বাসায়ই দারোয়ান নেই। তার বাসাটিতেও দারোয়ান ছিল না।
সরেজমিনে ঘটনার দিন সন্ধ্যায় দেখা যায়, নিলয়ের শোবার ঘরে মাটিতে জমাট বাঁধা রক্ত। দেয়ালেও রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। পুরো ঘর এলোমেলো। সেখানে একটি বড় খাট, স্টিলের আলমারি, কাঠের শেলফ ও তার পাশে ছোট একটি চৌকি। বড় খাটটির পাশে পড়ে আছে ছোট একটি বাজারের ব্যাগ। শোবার ঘরের পাশে বেশ ছোট একটা জায়গা- সেখানে একটি ড্রেসিংটেবিল ও তার পাশেই রান্না ঘর। ভাত ও আলু ও করলা ভাজি রান্না করা ছিল সেখানে। রান্না ঘরের চুলার অন্তত আট ফিট উল্টো দিকে একটি দরজা। এর ওপাশে একটি ছোট বারান্দা। নিলয় ছাড়া যারা ওই ফ্ল্যাটে সাবলেট থাকেন তারা ওই বারান্দা ব্যবহার করতেন। নিলয়কে কুপিয়ে হত্যার সময় ওই বারান্দায়ই আটকে রাখা হয়েছিল আশা ও তন্বীকে। সকালে নাস্তা না করেই মাসের বাজার করে বাসায় ফিরেছিলেন নীলাদ্রি বলে জানান আশা মনি।
এদিকে, ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায়, নিহত বস্নগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়ের শরীরে কোপের জখম পাওয়া গেছে একটি-দুটি নয়, ১৪টি। এর মধ্যে ১০টি মাথায় ও ঘাড়ে। বাকি ৪টি শরীরের অন্যান্য জায়গায়। গলার বাম পাশে একটি কোপ ১৫ ইঞ্চি লম্বালম্বিতে গভীরে ঢুকে গেছে। কোপের ধরনগুলো এলোপাতাড়ি। ধরন দেখে বোঝা যায়, একাধিক ব্যক্তি আক্রমণ করেছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। গতশনিবার নিলয় নীলের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা এসব তথ্য জানান।
অপরদিকে, দেশে ধর্মীয় উন্মাদনায় অব্যাহত হত্যা ও হুমকির মুখে মুক্তচিন্তার বস্নগাররা যারা সুযোগ পাচ্ছেন তারা কেউ দেশ ছাড়ছেন, কেউ ঘরে স্বেচ্ছাবন্দিত্ব বেছে নিচ্ছেন। নিরাপত্তার জন্য পুলিশের কোনও সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে তাদের। হত্যার হুমকির মুখে প্রথাবিরোধী প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আজাদের ছেলে বস্নগার অনন্য আজাদ প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন জার্মানিতে। সেখানে তিনি আশ্রয় চাওয়ার আবেদন করবেন বলেও জানা গেছে। অনন্য আজাদেও ফেসবুক ও বিভিন্ন সুত্র অনুযায়ী জানা যায়, তিনি বস্নগারদের হিটলিস্টের পরবর্তী টার্গেট ছিলেন। তাঁকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল। তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে জার্মানিতে একটি স্কলারশিপ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। আর জার্মানি যাওয়ার পর সেখানে তোলা ছবি ফেসবুকে আপ করেছেন। জার্মানি থেকে মঙ্গলবার রাতে অনন্য আজাদ জানান, আমি হুমকির মুখে জীবন বাঁচাতেই জার্মানি চলে এসেছি। কবে ফিরবো জানি না। দেশে আমি নিরাপত্তা পাইনি।
এছাড়াও, হুমকির মুখে চাকরি ছেড়ে জিডি করে স্বেচ্ছাবন্দিত্ব গ্রহণ করা বস্নগার মাহমুদুল হক মুন্সি বাধন বলেন, বস্নগারদের এখন আর পুলিশের ওপর আস্থা নেই। তাই তারা আর পুলিশের কাছে যান না বা অভিযোগ করেন না। আমার মতো আরও অনেক বস্নগার হয় ঘরে স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে আছেন, নয়তো জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন। তিনি আরো জানান, তাকে গত বছরের আগস্টে পাঁচ দফা হত্যার হুমকি দেয়া হয় ফেসবুক ও টেলিফোনে। এরপর তিনি পল্লবী থানায় জিডি করেন (নম্বর-১৭৭৫)। কয়েকদিন তার বাসার সামনে পুলিশ ঘোরাঘুরি করেছে। তারপর আর খোঁজ নেয়নি। তাকে ফেসবুকে হুমকি দেয়ার স্ক্রিন শটও তিনি জিডির সঙ্গে দিয়েছিলেন পুলিশকে। কিন্তু সেই জিডির তদন্ত বা হুমকিদাতাদের চিহ্নিত করার কোনও উদ্যোগ নেয়নি পুলিশ। বাধন জানান, এখন আমি ঘরেই থাকি। একটি আইটি ফার্মে চাকরি করতাম তাও ছেড়ে দিয়েছি। আর বাইরে বের হই না। খুব প্রয়োজন হলে কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাই।
মৃত্যুর হুমকি পেয়ে অনেকটা আত্মগোপনে থাকা বাংলাদেশের এক বস্নগার 'একুশ তাপাদার' বিবিসি বাংলার কাছে বর্ণনা করেছেন তার পলাতক জীবনের অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, নীলাদ্রি চ্যাটার্জির হত্যার খবর পেয়ে প্রথমে শোকে মুষড়ে পড়লাম। এটা ছিল প্রথম অনুভূতি। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে শোকের জায়গায় এলো ভয়ের অনুভূতি। এটা আমার ভাগ্যেও ঘটতে পারে। আমার নিজের ঘরেই এখন আর আমি নিরাপদ নই। আমাদের যখন তালিকা করে প্রথম হত্যার হুমকি দেয়া হয়, তখন আমরা এটা ততটা সিরিয়াসলি নিইনি। কিন্তু যখন একের পর এক হত্যাকা- শুরু হলো, তারপর থেকে আমরা অনিরাপদ বোধ করতে থাকি। আমার স্বাভাবিক চলাচল এখন গন্ডি বদ্ধ করে ফেলতে হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বস্নগার ও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ জন ইউরোপের দেশে চলে গেছেন। আরো অনেকে দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। যারা এর মধ্যে বিদেশে চলে গেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- বস্নগার আসিফ মহিউদ্দিন, ওমর ফারুক লুঙ্, অনন্য আজাদ, মশিউর রহমান বিপ্লব ও রাসেল পারভেজ। তারা নিজেই এ তথ্য বিভিন্ন সময় নিজের ফেসবুক ওয়ালে বা বস্নগে লিখে শুভাকাঙ্খীদের ।