প্রবল বৃষ্টি আর কাদায় বিপন্ন রোহিঙ্গাদের জীবন
পাহাড় ধস : মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়
মানুষ মরে বাস্তবায়ন হয় না সুপারিশমালার
মশিউর রহমান রুবেল
প্রবল ও টানা বৃষ্টি এবং ছোট-খাটো ভূমি ধসের কারণে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এখন বেহাল দশা। মনুষ্য সৃষ্ট এই বিপর্যয়ে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের জীবন। পানি এবং কাদামাটিতে একাকার হয়ে গেছে ক্যাম্পের কোনো কোনো জায়গা। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের পরে এবং ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার পর ৮ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। নতুন এবং পুরনো-সব মিলিয়ে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখন বসবাস করছে কঙ্বাজারের উখিয়া এবং টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে।
পুরো কঙ্বাজার জেলায় ৫ হাজার ৮শ একর ভূমি এখন রোহিঙ্গাদের দখলে। কৃষিজমি, পাহাড় বন উজাড় করে নির্মিত এই বসতি বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্যই এখন বিরাট ঝুঁকি তৈরি করেছে। বর্ষা শুরুর বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সতর্ক করে দিয়েছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা ভূমি ধস, ঝড় এবং বন্যার ঝুঁকিতে আছে। যদিও পূর্ব প্রস্তুতি থাকার কারণে বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় ঘটেনি বলে জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, বিভিন্ন সংস্থার ত্রাণ কর্মীরা হাঁটু পর্যন্ত পানির ভেতর দিয়ে হেঁটে ক্যাম্পে ঢুকছেন এবং তাদের ত্রাণ কাজ পরিচালনা করছেন। অনেক জায়গায় রোহিঙ্গারা হাঁটু সমান উচ্চতার পানিতে দাঁড়িয়ে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছেন। বর্ষা মওসুম শুরুর আগেই স্থানীয় প্রশাসন প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করেছিল যারা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করছেন।
সে তালিকার উপর ভিত্তি করে গত ১০ জুন পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে জানালেন শরণার্থী ত্রাণ এবং প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম। তিনি জানান বাকিদের সেখান থেকে সরিয়ে নেবার কাজ চলছে।
প্রশাসনের হিসেবে ৫০ হাজার মানুষের মধ্যে প্রায় অর্ধেক তীব্র ভূমি ধসের ঝুঁকিতে এবং বাকি অর্ধেক বন্যার ঝুঁকিতে ছিল বলে উল্লেখ করেন শরণার্থী বিষয়ক কমিশনার। ভূমিধস এবং অতিবৃষ্টির কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কোনো প্রাণহানি হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন। এদিকে ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ১২৭ জন নিহত হওয়ার পর একটি সরকারি কমিটি ৩৬ দফা সুপারিশ করে। পাহাড় ধসে প্রাণহানি বন্ধ করতে গত বছর আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে সরকারের কাছে ১২ দফা সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেয় পরিবেশ অধিদফতর। ঐ প্রতিবেদনে, ধস ঠেকাতে পাহাড় ও টিলা সংরক্ষণে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ কঠোরভাবে প্রতিপালন, পাহাড়ি এলাকায় ভূমিক্ষয় রোধে বনায়ন, পাহাড় সংরক্ষণ টেকসই কৃষির প্রবর্তন, পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ম্যাপিং, জোনিংসহ পাহাড়ি এলাকার বিস্তারিত তথ্যভা-ার গড়ে তোলা, পাহাড় সংরক্ষণ, পাহাড়ি এলাকার ব্যবহার সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, টেকসই পাহাড় ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছিল। আর এই বছরের ঐ একই দিনে ১১ জন মারে গিয়ে প্রমাণ করেছেন ঐসব সুপারিশমালা বাস্তবায়ন দূরের কথা উল্টো নিহতের কাঁধেই তার নিজের মৃত্যুর দায় চাপানো হচ্ছে। প্রত্যেকবার পাহাড় ধসে প্রাণহানির পরই কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়ে দায় সারে। আর যাদের ওপর সবচেয়ে বেশি দায় বর্তায় তারা প্রতিবছর বর্ষা এলেই পাহাড় ধস রোধে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাসহ উচ্ছেদের মতো অস্থায়ী কিছু ব্যবস্থা নেয়। শেষ মুহূর্তে পাহাড়ের ঢাল থেকে লোকজন সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করে তারাও দায় সারে। কিন্তু প্রতি বছর পাহাড় ধসের পর দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশমালা আরও দীর্ঘ হলেও বাস্তবায়ন হয় না। প্রতিবার পাহাড় ধসের পর সরকারের নেতা মন্ত্রীদের আরেকটি মনোভাব দেখা যায়। গণমাধ্যমের সামনে তারা বলতে থাকেন, পাহাড়ের ঢাল থেকে লোকজনকে সরে যেতে বলা হলেও তারা সরে না। ফলে প্রাণহানি হয়। সেই সাথে দায় চাপান প্রকৃতির ওপর।
বর্ষা মওসুম শুরুর তিন মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। সারাবছর কঙ্বাজার অঞ্চলে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়, গত তিনদিনে সেটির এক তৃতীয়াংশ হয়ে গেছে। এ থেকে বোঝা যায় বৃষ্টিপাতের মাত্রা কতটা প্রবল ছিল। স্থানীয়রা বলেছেন, বৃষ্টি এবং কাদার জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে হাঁটার কোনো অবস্থা নেই। তারা বলছেন, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের কর্মীদের ঈদের ছুটিও বাতিল করেছে। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গার বাসস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে কর্মকর্তারা বলছেন। বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্ট-এর জান্নাতুল ফেরদৌস উখিয়া ক্যাম্পের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখেছেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী ক্যাম্পে ঢুকতে মূল সড়কগুলো পানির নিচে তলিয়ে গেছে। রাস্তার দু'পাশে শরণার্থীদের অধিকাংশ ঘরে পানি ঢুকেছে। যাদের ঘর পাহাড়ের পাদদেশে, ঢালে কিংবা উপরে তাদের সেখান থেকে সরিয়ে ক্যাম্প এলাকার মধ্যে অবস্থিত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানান জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি বলেন, যাদের ঘরে পানি উঠেছে তারা উঁচু জায়গায় অবস্থিত অন্য শরণার্থীদের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। শিশু এবং বয়স্করা সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে। গত দু'দিন যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে সেটি আরো কয়েকদিন অব্যাহত থাকলে প্রচুর ভূমিধসের আশংকা আছে বলে তিনি মনে করেন।
উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত একজন বাসিন্দা দিল মোহাম্মদ জানালেন, তিনি যেখানে বসবাস করছেন সেখানে ৫ শতাংশ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গারা অন্য রোহিঙ্গাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে বলে তিনি জানান। তার ভাষ্য মতে, ভূমিধস নিয়ে নানা আশংকা এবং প্রচারণা থাকার কারণে রোহিঙ্গাদের অনেকেই বৃষ্টি শুরুর সাথে সাথে সতর্ক হয়ে গেছে। তবে এখনো অনেকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। তবে পাহাড় ধসে মঙ্গলবার ১১ জন নিহত হয়েছে। এই সংখ্যা যে এখানেই থেমে থাকবে না তা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। জীবিত মানুষ মরে গিয়ে সংখ্যায় পরিণত হবে। বিপর্যয় বাড়তে বাড়তে ক্রমেই মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিচ্ছে।
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।