শৈশবের ঈদ
মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত হোসেন
প্রতি বছর পবিত্র রমজানের শেষে সমগ্র মুসলিম জাহানে উপস্থিত হয় মহিমান্বিত ঈদুল ফিতর। ঈদ আসলে সমগ্র মুসলিম জাহান নির্মল আনন্দে মেতে উঠে। শান্তির সুশীতল আভায় ভরে উঠে প্রকৃতি। মানব হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। এই ঈদ আসলেই মনে পড়ে শৈশবের কথা। তখনকার ঈদ আর আজকের দিনের ঈদের মধ্যে ব্যবধান তেমন কম নয়। অনেক কিছুতেই এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। কতই না মধুর ছিল শৈশবের ঈদ! পুরো রমজান মাস জুড়ে চলতো ঈদের প্রস্তুতি। কাকে কাকে নিয়ে জুটি হবে ঈদের দিনের, জামা-কাপড় কোথা থেকে কখন কেনা হবে এসব নিয়ে জল্পনা কল্পনা আর কৌতূহলের কমতি ছিল না। ঈদের জামা-কাপড় কিনে আনার পর আলমারীতে যত্ন করে লুকিয়ে রাখতাম যাতে করে ঈদের আগে আর কেউ না দেখে। ঈদের আগে নতুন জামা-কাপড় কেউ দেখে ফেললে পুরনো হয়ে যাবে এমনটিই ছিল অনুভূতি। কতই না উচ্ছ্বাস ছিল ঈদের কেনাকাটা নিয়ে। ঈদ উপলক্ষে ঈদ কার্ড বিনিময় ছিল ব্যাপক। ঈদ কার্ডের বিনিময়ে দাওয়াত না করলে বন্ধু-বান্ধবরা রাগ করতো। কে কার চাইতে সুন্দর ঈদ কার্ড বিনিময় করতে পারে তার একটা প্রতিযোগিতাও মনে মনে চলতো সবার মধ্যে। তাই পনের বিশ রমজানের পর থেকে শুরু হতো ঈদ কার্ড সংগ্রহের জন্য তোড়জোড়। অনেকেই আবার ঈদ কার্ড কিনে তার ভিতরে থাকা সাদা কাগজে বিভিন্ন ধরনের কবিতার লাইন বা তার প্রিয় বন্ধুটির জন্য হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার কথা দু'কলম লিখে দিতেন যার মধ্যে আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিল প্রকট। শুধু যে ঈদ কার্ড বিনিময় তা কিন্তু নয়। অনেকেই ঈদ উপলক্ষে ঈদ কার্ডের পাশাপাশি হিসেবে বইও উপহার দিতেন। এতিহ্যবাহী ঈদ কার্ড এখন কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে। ঈদ কার্ডের পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে ই-কার্ড বা ইলেকট্রনিক কার্ড। যেমন ইমেইল, ফেইসবুক, টুইটার কিংবা মোবাইলের এস এম এস এর মাধ্যমে এখন ঈদের দাওয়াত সেরে নেয়া হয়। কিন্তু আগের মতো সে আন্তরিকতার ছোয়া আর পাওয়া যায়না। ঊনত্রিশ কিংবা ত্রিশ রমজানের সন্ধ্যে বেলায় চাঁদ দেখার জন্য সে কী কৌতুহল! দল বেঁধে উঠোনে কিংবা রাস্তায় ছুটাছুটি করতাম আর অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে খালি চোখে মুক্ত আকাশে চাঁদ খুঁজে বেড়াতাম। ঘরের চালের উপর দিয়ে কিংবা গাছের ডালের ফাঁকে উৎসুক দৃষ্টি শুধু ঘুরে বেড়াত কোথাও চাঁদ দেখা যাচ্ছে কি না। হঠাৎ কেউ একজন চিৎকার দিয়ে উঠতো ঐতো চাঁদ দেখা গেল বলে, তখনতো আনন্দের বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। পশ্চিম আকাশে শাওয়ালের একফালি চাঁদ দেখার সে কী নির্মল আনন্দ তা বলে বোঝানোর মতো নয়। চাঁদ দেখলেই হৈ হুল্লোড় করে পুরো এলাকায় মাথায় তুলতাম আর আতশ বাজি ফুটাতাম। তখন চাঁদ রাতে প্রতি ঘরে সেমাই বা সেমাই জাতীয় মিষ্টান্ন রান্না করা হতো যা ঘরের তৈরি ছিল অধিকাংশ। রমজানের দিনে মা-চাচীরা ঘরে বসে ঈদের দিনের জন্য বিভিন্ন ধরনের পিঠা বা নাস্তা বানাতেন যা এখন একেবারে নেই বললেই চলে। চাঁদ রাতের আরেকটি বিশেষ আনন্দ ছিল যাদের বাপ-দাদা গায়ের মসজিদে ইতেকাফ নিতেন তাদেরকে আনতে যাওয়া এবং তাদের সালাম করে দোয়া নেয়া। চাঁদ রাতে আর তেমন ঘুম হতো না শুধু এপাশ ওপাশ করেই রাত ফুরিয়ে দিতাম! খুব ভোরে সুগন্ধি সাবান নিয়ে বন্ধুরা সবাই মিলে নদীতে গিয়ে গোসল সেরে আসতাম। আর বাড়িতে মা-চাচী কিংবা বোনেরা ব্যস্ত থাকত উঠোনে ঝাড়ু দেয়া আর সেমাই সহ বিভিন্ন ধরনের রান্না তৈরিতে। গোসল করে এসেই শুরু হতো নতুন জামা কাপড় পরে, মাথায় টুপি লাগিয়ে ঈদগাহে ছুটে চলা। পুরো বছর ধরে অবহেলায় পড়ে থাকা ঈদগাহ ময়দানটিও ঈদের দিন বিশেষভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নতুনরূপে সেজে উঠতো। ঈদের নামাজ শেষ হলে কবরস্থানে জিয়ারত করে দৌড়ে চলে আসতাম বাড়িতে। ঈদগাহ থেকে ফিরে প্রথমেই মা-বাবাকে সালাম করা ছিল প্রধান কাজ। তারপর বেরিয়ে পড়া বন্ধুদের সাথে আত্নীয় স্বজনের বাড়িতে। খাওয়া দাওয়ার চাইতে বেশি ভালো লাগত ঈদ সালামি হিসেবে যখন টাকা পেতাম। এ বাড়ি ও বাড়ি করে প্রায় সব আত্নীয়দের বাড়িতে যাওয়া হতো আর প্রত্যেক বাড়িতেই উপহার হিসেবে টাকা পেতাম কম বেশি তাই মাঝে মধ্যে টাকাগুলো পকেট থেকে বের করে গুনে দেখতাম আর অন্যরকম এক আনন্দ উপভোগ করতাম। খুব বেশি ভালো লাগত যখন কেউ নতুন টাকা দিতেন। নতুন টাকা যত্ন করে রেখে দিতাম অনেকদিন। দূরের আত্মীয়দের বাড়িতে যাওয়ার জন্য চার-পাঁচ জন মিলে এক রিকশায় চড়ে বসতাম, ঠাসাঠাসি করে রিকশায় বসে বেড়ানোর আনন্দটাও ছিল অন্যরকম! ঐদিনগুলো আর কখনো ফিরে পাবো না কিন্তু দিনগুলোর কথা মনের গহীনে গেঁথে থাকবে চিরদিন। সময়ের ব্যবধানে আজ আমি নিজ গ্রাম আর মাতৃভূমি থেকে অনেক দূরে। দীর্ঘ দেড় যুগ আপনজনদের সাথে ঈদ করা হয়না। জানিনা আর কখনো করা হবে কিনা! ঈদ আসে ঈদ যায়, সবাই আপনজনদের নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। সেই গ্রাম, বিশাল ঈদগাহ ময়দান, গ্রামের পাশে বয়ে চলা কর্ণফুলী নদী সবই আছে আগের মতো শুধু নেই আমি। বড় হয়ে গেছি অনেক। এখন আমি দায়িত্বশীল মানুষ। আর তাই দায়িত্বের বোঝা কাঁধে নিয়ে পড়ে আছি মা আর মাতৃভূমি থেকে যোজন যোাজন দূরে। ঈদের দিনের কথা মনে হলেই বঞ্চিত জীবনের সঞ্চিত ব্যথাগুলো গলে পড়ে চোখের লোনা জল হয়ে। ব্যথাহত হৃদয় হামাগুড়ি দিয়ে খুঁজতে থাকে ফেলে আসা অতীত স্মৃতি।
মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত হোসেন : ঔেষশ
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।