মানবকল্যাণে সুফিতত্ত্ব
মাহমুদুল হক আনসারী
মানব ও ধর্ম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ধর্ম হচ্ছে মানবতার কল্যাণে অথবা মানব মুক্তির উদ্দেশ্য। পৃথিবীতে বহু ধর্ম গোত্র জাতি আছে। ধর্মীয় বিভাজন আছে। দুনিয়ার নানা প্রান্তরে প্রতিদিন ধর্মীয় ও গোত্রগত হানাহানি সংঘাতের কথা শুনতে পাওয়া যায়। ধর্মের বাণী সর্বদা কল্যাণে ও সুখময় হয়। যে যার ধর্মপালন ও লালন করলে সেখানে শান্তিপ্রাপ্তি ঘটে। ধর্মের বাণী বা বক্তব্য অনুসরণ অনুকরণ ব্যক্তি পরিবার ও রাষ্ট্রে শান্তি শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করে। আমাদের এ উপমহাদেশে ধর্মীয় গোত্রীয় হানাহানি হাঙ্গামা ফ্যাসাদ একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। বিশেষ করে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে ধর্মীয় ভাব আবেগ বেশি হলেও এখানে ধর্মীয় হানাহানি ও বেশি। ধর্মের বাণীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও অনুসরণে অনেক গাফলতি আছে। ধর্মের বাণীতে যে সকল উপদেশাবলী পাওয়া যায় সে সকল উপদেশ ধর্ম অনুসারীগণ অনুসরণ করে বলে মনে হয় না। ধর্মের বাণী উপদেশ হচ্ছে মানব কল্যাণ সাধন করা। সব ধরনের সৃষ্টির প্রতি যত্ন ও শ্রদ্ধাশীল হওয়া। অহেতুক অন্যায় জুলুম ব্যভিচার করে মানব সমাজে অশান্তি সৃষ্টি না করা। এক কথায় মানবতার ক্ষতিগ্রস্ত এমন ধরনের যাবতীয় কর্ম হতে দূরে থাকা। কিন্তু কোনো ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে এসব মহান উন্নত আদর্শ দেখা মিলছে না। ধর্মকে যারা পুঁজি করে জীবন নির্বাহ করে তাদের মধ্যে ও ধর্মের অনুসরণ অনুকরণ পাওয়া যায় না। ধর্মকে একটা জীবন জীবিকার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছে একটি গোষ্ঠী। তাহলে প্রকৃত ধর্মের আদর্শ কী। ধর্ম ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রে কী শিক্ষা দিতে চায়। এসব বিষয়ের উত্তর কিন্তু কোন ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে পাওয়া যাবে না। কারণ তাদের মধ্যে একটা গোঁড়ামি কাজ করে। যে যার ধর্মের মধ্যে আছে, সেখানেই সীমাবদ্ধ। আজকের সংঘাতময় পৃথিবীতে ধর্মের কারণে হানাহানি বেশি দেখা যাচ্ছে। নানা রঙের নাম আর গোত্র ব্যবহার করে হানাহানি সংঘাত আর সমপ্রীতি নষ্ট করছে নানা শ্রেণির মানুষ। ধর্মের মূল উদ্দেশ্য শৃংখলা ভ্রাতৃত্ব, আনুগত্য ও ত্যাগ থাকার কথা। কিন্তু ধর্ম মানুষকে আলাদা করে ফেলছে। ধর্মগ্রন্থকে ধর্মীয় নেতারা কতিপয় স্বার্থ নিয়ে ভাগ করে উপস্থাপনা করতে দেখা যাচ্ছে। কেউ এটাকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। কোনো ধর্ম গোষ্ঠী তার ধর্মকে পরিচ্ছন্ন রাখে নাই। ক্ষমতা অর্থ দুনিয়ার লোভ লালসার হাতিয়ার হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে যুগে যুগে কিছু মনীষী ধর্মের আবরণে সমাজে আবির্ভাব হয়েছে। তারা নিতান্ত ধর্মের কারণে সমাজে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় প্রচার আচার পালন ও লালনে শিক্ষা দিয়েছেন। তারা মানুষকে নিজ নিজ ধর্মপালন ও অনুসরণ অনুকরণ করার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি ও রেজামন্দি হাসিল করার উপদেশ দিয়েছেন। সমাজে এ জাতীয় মানুষের সংখ্যা খুব একটা বেশি না হলেও তারা অবশ্যই আলোকিত মানুষ। যুগ যুগ ধরে এ ধরনের আলোকিত মানুষ সমাজে তৈরি হয়েছিলো এখনো কিন্তু তাদের পদচারণা আছে। তাদেরকে অনেকেই আধ্যাত্মিক গুরু বা সাধক হিসেবে জানে। তাদের চালচলন বেশ ভূষণ তেমন চাকচিক্য নয়। তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকে, সাধারণ মানুষের মতো করে চলে। রাজনীতি-সমাজ-পরিবার হতে তারা একপ্রকার অনেক দূরে থাকে। তাদের মধ্যে কোন লোভ হিংসা নেই। এরকম কিছু মহান সাধক যাদের নিজেদের তেমনভাবে পরিচয় হতে দেখা যায়না। তাদের চালচলন অতি সাধারণ খাওয়া দাওয়া জীবন পরিচালনা অত্যন্ত নগণ্য। তারা মানুষের মাঝে বিচরণ করে কিন্তু মানুষ ও সমাজ তাদের চিনতে ও বুঝতে পারে না। তারা আধ্যাত্মিক সাধক-সমাজ-দেশ-রাষ্ট্র ও পৃথিবীর ধারক বাহক তারা। তাদের কারণে সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীকে ধারণ ও রক্ষা করে যাচ্ছেন। যারা সর্বদা মানবকল্যাণ ও উপকারের কথা চিন্তা করেন, তারাই সুফি সাধক। তারা অর্থবিত্তের জন্য দৌড়ায় না। তারা সমাজে হানহানি হাঙ্গামা সৃষ্টি করেননা। আমার জানা মতে দুনিয়ায় সমস্ত প্রকারের ধর্মপ্রচার ও প্রসারের অবদান এসব সুফী মানুষদের। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ধর্মীয় ত্যাগ ও কোরবানীর ফসল হচ্ছে সমাজে ধর্মীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও পালন। এসব সুফি সাধকগণ মানুষের অন্তর বা কলব তৈরি করতে সৃষ্টিকর্তার সাথে একটা সম্পর্ক তৈরিতে কাজ করেছেন, মানুষকে আধ্যাত্মিক জ্ঞানে ও বিজ্ঞানে তৈরি করেছেন। আধ্যাত্মিক জ্ঞান সেটা বহু মূল্যবান সম্পদ যেটা হযরত আলী (র.)-এর থেকে শুরু। যাবতীয় ধর্মের মধ্যে আধ্যাত্মিক সাধনা আর জ্ঞান না থাকলে সে ধর্ম পৃথিবীর বুকে বেশি দিন থাকেনা। এ আধ্যাত্মিক সাধনা আর সাধক না থাকলে পৃথিবীতে কোনো ধর্মের অস্তিত্ব বেশি দিন ঠিকবেনা। আজকের দুনিয়ায় যত ধর্মের লালন পালন আর অনুসরণ হচ্ছে সবখানেই আধ্যাত্মিক একটি গোষ্ঠী কিন্তু সেখানে কাজ করছে। হাজার আওলিয়ার পূণ্যভূমি বাংলাদেশ। এ অঞ্চলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত হাজার হাজার নেকবান্দা, আধ্যাত্মিক গুরু সাধক বাংলার জমিনে বিশ্রাম করছেন। পবিত্র ধর্মগ্রন্থে তাদের 'মৃত' না বলার জন্য বলা হয়েছে। যারা সাধক, আল্লাহর প্রেমে মশগুল হয়ে ধর্মের আচার-আচরণ-আবরণে জীবন উৎসর্গ করে। মানব সমাজ ও ধর্মকে উজ্জীবিত করেছেন তারা কখনো 'মৃত্যু' নামক জগতে থাকতে পারে না। তারা সর্বদা জীবিত এ কথায় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনে বলা হয়েছে। বার আউলিয়ার চট্টগ্রাম সারা বাংলাদেশে যে সকল মহান আধ্যাত্মিক ধর্মীয় রাহবার এবং নেতা রয়েছেন তারাই আধ্যাত্মিক সাধক। তারাই সমাজ ও ধর্মসংস্কারক। তাদের মাধ্যমেই দ্বীন, ধর্ম, ইসলাম, তাহযিব তমুদ্দুন, মিল্লাতে ইব্রাহীম বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে।
কোনো ধরনের জিহাদী সন্ত্রাসী আন্দোলন মিছিল মিটিং দিয়ে ইসলামের প্রচার প্রসার আর বৃদ্ধি সম্ভব হয়নি। যা হচ্ছে এবং হয়েছে তা হলো সুফিবাদ, আধ্যাত্মিক, খানেকাহ, মাদ্রাসা মসজিদের মাধ্যমে হচ্ছে। মহান সুফি সাধক আধ্যাত্মিক নেতারা তাদের খানেকাহ ও দপ্তরে বসে সমাজ মানুষ ও দুনিয়ার ভালোমন্দ নিয়ে চিন্তা করেন। ধর্মের হানাহানি বাড়াবাড়ী না করে মানব ও সমাজ কল্যাণে মানবতার মধ্যে ধর্মীয় বাণী প্রচার প্রসার করেন। এ ধরনের খানেকাহ আর দফতরে কোনো জঙ্গি রাজনীতি সন্ত্রাসী কর্মকা- হয় না। এখানে শিক্ষা দেয়া হয় শৃঙ্খলা আর ভালোবাসার মাধ্যমে। মানব হত্যা দুনিয়ার অশান্তি সৃষ্টির যাবতীয় অপকর্মের বিরুদ্ধে এখানে মানুষের অন্তরকে বিশুদ্ধ জিকির দোয়া দরুদ সালাতে নামাজের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এসব ধরনের ইমাম খতীব গুরুজনরাই হচ্ছেন আধ্যাত্মিক সাধক ও রাহবার। তারাই বাস্তবে সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষ। তারাই নির্ভুল নিরহংকার সমাজ নেতা। তাদের নিকট কোনো রাজনৈতিক অর্থনৈতিক উচ্চবিলাসী নেই। তারা একটি মিশন নিয়ে কাজ করেন। সেটা হচ্ছে মানুষকে আল্লাহুর প্রেমের সাগরে পৌঁছিয়ে দেয়া। আল্লাহ রাসূলের প্রেমে মানবতাকে পৌঁছাতে পারলেই তারা সার্থক। আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে গুণী ও শ্রদ্ধাবান মানুষ হচ্ছেন তারাই, যারা মানবতাকে মহান আল্লাহ ও রাসূলের প্রেমের সাগরে পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন। আধ্যাত্মিক এসব সাধকগণ অতি নগণ্য ও সাদাসিধেভাবে জীবন যাপন করেন। যাবতীয় খানেকাহ ও মসজিদভিত্তিক আধ্যাত্মিক সাধনার কেন্দ্র রয়েছে এসব কেন্দ্র নিঃসন্দেহে ধর্মীয় সাধনা ও জ্ঞানর্জনের কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রে মানুষ যাতায়াত করলে সেখান থেকে আলো পাওয়া যাবে। নিজের অন্তর ও জ্ঞানকে সমপ্রসারিত করতে পারবে। মন অন্তর সৃষ্টি জগতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দায়িত্ববান হবে। নিজ পরিবার সামাজিক জীবন সুন্দর করতে সর্বোপরি মহান আল্লাহ তাআলার রেজামন্দি হাসিল করতে সুফীতত্ত্ব গবেষণা ও সাধনার বিকল্প নেই। উন্নত চরিত্র ও জীবন গঠনে আধ্যাত্মিক সাধনা ও জ্ঞানর্জন সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে পারে। আসুন প্রকৃত ধর্ম পালন ও অনুসরণ অনুকরণে সন্ত্রাস জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সুফী সাধনা ও গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়ে আলোকিত সমাজ গঠনে এগিয়ে আসি।
মাহমুদুল হক আনসারী : কলামিস্ট
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।