প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে প্রয়োজন শিক্ষা ও কর্মসংস্থান
চিত্ত ফ্রান্সিস রিবেরূ
উর্মির বয়স তিন বছর। সে হাঁটতে পারে না, নিজের হাতে খেতেও পারে না। কথা যা একটু বলতে পারে তাও আটকে যায়। সারাদিন বিছানায় শুয়ে বসে তার দিন কাটে। বৃষ্টির যাবতীয় কাজ মাকে করে দিতে হয়। তার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে মা সবসময় চিন্তিত থাকেন।
উর্মির মত বহু প্রতিবন্ধি শিশু আমাদের দেশে আনাচে কানাচে অসহায় জীবনযাপন করছে। যে সব শিশু স্বাভাবিক শিশুর মত নয় অথবা শারীরিক ও মানসিকভাবে অস্বাভাবিক তাদেরকেই আমরা প্রতিবন্ধী শিশু বলে থাকি। এদের শারীরিক, মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক শিশুর মত নয়। এদের দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি ও বিকাশ ত্রুটিপূর্ণ। তারা পঞ্চইন্দ্রিয়ের সঠিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যার ১০ থেকে ১৫ ভাগ প্রতিবন্ধী। সে হিসাব অনুযায়ী দেড় কোটির ওপরে প্রতিবন্ধী রয়েছে।
প্রতিবন্ধী শিশুদের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করা যায়- (১) শারীরিক ও মানসিকভাবে এরা স্বাভাবিক নয় (২) অন্যের সাহায্য এদের চলাফেরা করতে হয় (৩) বয়স অনুযায়ী এদের বিকাশ যথাযথ হয় না (৪) এরা হীনমন্যতায় ভোগে (৫) এদের খাদ্য ও শিখনে ভিন্নতা রয়েছে (৬) এদের আচার, আচরণ অস্বাভাবিক এবং (৭) এদের শারীরিক গঠনও ত্রুটিযুক্ত। প্রতিবন্ধী শিশুদেরকে প্রধানত দু্থটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধী। মানসিক প্রতিবন্ধীদেরকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধীও বলা হয়। আবার শ্রবণ, বাক, দৃষ্টি ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয়েছে শারীরিক প্রতিবন্ধীকে। প্রতিবন্ধী জন্মগতভাবে হতে পারে আবার অসুস্থতা, আঘাতজনিত কারণেও হতে পারে।
প্রতিবন্ধী কোন রোগ নয়। এটি এক ধরনের শারীরিক অক্ষমতা। এর জন্য প্রতিবন্ধী শিশু কোনোভাবেই দায়ী নয়। প্রতিবন্ধীরা সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। তাদের মধ্যে অনেক প্রতিভা লুকিয়ে আছে। উপযুক্ত পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাদের প্রতিভার উন্মেষ ঘটাতে পারলে তারা সমাজ ও অর্থনীতিতে অনেক অবদান রাখতে পারে। এ বাস্তবতায় সরকারের পাশাপাশি অনেক বেসরকারি সংগঠন প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে কাজ করছে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে দারিদ্র্যবিমোচন, স্বাস্থ্য, মানসম্মত শিক্ষা, সুপেয় পানি ও পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি, উদ্ভাবন ও উন্নত অবকাঠামোর মত লক্ষ্যগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো নিশ্চিত করতে সরকার ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। দারিদ্র্যবিমোচন ও ক্ষুধামুক্তির জন্য সরকারিভাবে প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন হারে ভাতা দেয়া হচ্ছে। টেকসই স্বস্থ্যের জন্য স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি তাদের পুনবার্সন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম সহজলভ্য করতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মধ্যে বছরের শুরুতে ব্রেইল বই বিতরণ করা হয়েছে। ইনক্লুসিভ এডুকেশন কার্যক্রমকে জোরদার করা হচ্ছে।
শিক্ষা ছাড়াও প্রতিবন্ধী শিশুরা খেলাধুলা, বিনোদন, সামাজিক ক্রিয়াকলাপে স্বাভাবিক শিশুদের মতো সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে না। এসব শিশুর শারীরিক অক্ষমতার প্রতি লক্ষ্য রেখে তাদের জন্য বিশেষ শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে হবে। যদি এদের প্রতিবন্ধিতার ধরন ও প্রকৃতি অনুসারে শিক্ষাক্রম গঠন করা হয় তাহলে এর সুফল পাওয়া যাবে। শারীরিক অস্বাভাবিকতার কারণে তারা আবেগ প্রবণ হয়। সে কারণে তাদের সামাজিক ও আবেগের বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। তাদের শিক্ষার জন্য এমন স্কুল বা সাংগঠনিক পরিবেশের ব্যবস্থা করা দরকার যাতে তারা হীনমন্যতায় না ভুগে তাদের ভেতর আত্নবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা যায়। তাদের বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক বা প্রশিক্ষকের সাহায্যে এমন পেশাগত প্রশিক্ষণ দিতে হবে যা তাদের শারীরিক দক্ষতার বিকাশে সহায়ক হয়। শিক্ষকদের লক্ষ্য হবে এসব শিশুদের এমনভাবে পরিচালিত করা যাতে করে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। এর ফলে তারা তাদের জীবন মান উন্নয়ন এবং শিক্ষার উদ্দেশ্য পূরণ করতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি তাদেরকে প্রয়োজন চিকিৎসা সহায়তা দেয়া। প্রতিবন্ধী শিশুদের উচ্ছিষ্ট ভেবে তাদের প্রতি অযত্ন বা অবহেলা করা উচিত নয়- এ বোধোদয় এবং দায়বদ্ধতা আমাদের সবার মধ্যেই থাকতে হবে।
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দরিদ্র, অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত প্রতিবন্ধী শিশুকিশোরদের শিক্ষা লাভের সহায়তা হিসেবে ২০০৭-০৮ অর্থ বছর থেকে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচি প্রবর্তন করেছে সরকার। সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে শুরুতে ১২ হাজার ২০৯ জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে এ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। এ কর্মসূচির আওতায় মাসিক উপবৃত্তির হার প্রাথমিক স্তরে ৩০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৪৫০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৬০০ টাকা এবং উচ্চতর স্তরে ১০০০ টাকা। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় অর্থাৎ ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে প্রতিবন্ধী উপকারভোগীর সংখ্যা ছিল ১৩ হাজর ৪১ জন এবং বার্ষিক বরাদ্দ ছিল ৬ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে ৮০ হাজার জনের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে সাড়ে ৫৪ কোটি টাকা।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সরকারিভাবে বিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। এ সব বিদ্যালয়গুলো হচ্ছে বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের পাশাপাশি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ও আছে। মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রামের রৌফাবাদে অবস্থিত। শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের জন্য সমাজসেবা অধিদফতর ৭টি শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় পরিচালনা করছে। এ সব বিদ্যালয়ে ছাত্রদের ইশারা ভাষা শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষা প্রদান করা হয়।
জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন দেশের অনগ্রসর, বঞ্চিত, অসহায়, প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক এবং জন্মগতভাবে কিংবা অন্য যেকোন কারণে শারীরিক ও মানসিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর কল্যাণ, উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও ক্ষমতায়নের জন্য বহুমাত্রিক সেবা প্রদান করছে। প্রতিবন্ধী এ জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে ফিজিওথেরাপি অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি সেবার পাশাপাশি কাউন্সেলিং, পরামর্শ, তথ্য এবং রেফারেল সেবা প্রদানসহ অন্যান্য চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ২০০৯-২০১০ অর্থ বছরে দেশের পাঁচটি জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র চালু করা হয়। এসব কেন্দ্রের সাফল্যের ভিত্তিতে ২০১৪-১৫ অর্থ বছর পর্যন্ত দেশের ৬৪টি জেলায় ১০৩টি কেন্দ্র চালু করা হয়। সরকার পর্যায়ক্রমে সব উপজেলায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র, অটিজম কর্ণার, টয় লাইব্রেরি কার্যক্রম সমপ্রসারণ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে স্থাপিত কেন্দ্রসমূহে এ যাবৎ প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার প্রতিবন্ধী শিশু বা ব্যক্তিকে বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান করা হয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি দেশেই প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রধান কারণ মূলত বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগ, দুর্ঘটনা এবং যুদ্ধ। ভিন্ন মানববৈচিত্রের অধিকারী প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা তথা সার্বিক সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। প্রতিবন্ধীরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং আমাদেরই সন্তান। তাদের সবর্োচ্চ সামর্থ্যকে সম্পৃক্ত করতে পারলে আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় তারাও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। তাদেরকে নিয়েই আমাদেরকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে হবে। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান, সামাজিক সেবাসমূহ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা আরও গতিময় হবে।
পিআইডি ফিচার
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।